এমনও হয়েছে যে একাধারে ৪ দিন একই চেয়ারে বসিয়ে রাখা হয়েছে; কোন খানাপিনা দেয়া হয়নি। তাঁর সামনে অন্যরা পানি পান করতো অথচ তাঁকে এক গ্লাস পানি দেওয়া হতো না। সাইয়েদ কুতুবের ওপর এইভাবে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন সত্ত্বেও তিনি সময় পেলেই জেলে দাওয়াতী কাজ করতেন। ইখওয়ানুল মুসলিমীন নিয়ে ভাবতেন ও বিভিন্ন পরিকল্পনা করতেন। তিনি ঈমানী চেতনায় এত বেশি উদ্দীপ্ত ছিলেন যে, কোন সময়ই অন্যায়ের সাথে আপোষ করতে চাননি। কারাগারে যাওয়ার ১ বছর পরই সরকারের পক্ষ থেকে প্রস্তাব দেওয়া হয় যে, ’’যদি আপনি ক্ষমা চেয়ে কয়েকটি লাইন লিখে দেন, যা বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশ করা হবে, তাহলে আপনাকে মুক্তি দেওয়া হবে। আপনি জেলের কষ্টকর জীবন থেকে মুক্তি পেয়ে ঘরে আরামে থাকতে পারবেন’’। উক্ত প্রস্তাব শুনে সাইয়েদ জবাব দিলেন- “আমার অবাক লাগে যে, এ সকল লোকেরা মযলূমকে বলছে যালিমের কাছে ক্ষমা ভিক্ষা চাইতে। আল্লাহ্র শপথ! যদি কয়েকটি শব্দ উচ্চারণের ফলে আমাকে ফাঁসির মঞ্চ থেকে নাজাত দেয় তবু আমি তা বলতে প্রস্তুত নই। আমি আমার রবের দরবারে এমনভাবে হাজির হতে চাই যে, আমি তাঁর উপর সন্তুষ্ট আর তিনি আমার উপর সন্তুষ্ট।”জেলখানায় যখনই তাকে ক্ষমা চাইতে বলা হত, তিনি বলতেন- “যদি আমাকে কারাবন্দী করা সঠিক হয়, তাহলে সঠিক সিদ্ধান্তের উপর আমার সন্তুষ্ট থাকা উচিত। আর যদি অন্যায়ভাবে আমাকে কারাগারে আটক রাখা হয়, তাহলে আমি যালিমের কাছে করুণা ভিক্ষা চাইতে রাজি নই।”এরপর সরকারের পক্ষ থেকে টোপ দেয়া হয়, তিনি যদি সম্মত হন তাহলে তাকে শিক্ষা মন্ত্রণায়ের দায়িত্ব দেয়া হবে। সাইয়েদ এ প্রস্তাব শুনে প্রতিক্রিয়ায় বলেন- “আমি দুঃখিত। মন্ত্রীত্ব গ্রহণ আমার পক্ষে সে সময় পর্যন্ত সম্্ভব নয়, যতক্ষণ না মিসরের পুরো শিক্ষাব্যবস্থাকে ইসলামী ছাঁচে ঢেলে সাজাবার এখতিয়ার দেয়া না হবে।
আল্লাহ্ সাইয়েদ কুতুবকে এক বিরাট যাদুকরী সম্মোহনী শক্তি দিয়েছিলেন। কারাগারের সকলেই তাঁকে শ্রদ্ধা করতো, সম্মান করতো। তাঁর কাছে সকল কথা খুলে বলতো। কারাগারের বিভিন্ন বিষয় তিনি মীমাংসা করতেন। হাজতী, কয়েদীদের পরস্পরে ঝগড়া হলে তিনি বিচার করতেন। তাই তাঁকে উপাধি দেয়া হয় ‘কাজী উস সিজন’ -কারাগারে বিচারপতি। যখন কোন কয়েদীকে অন্য স্থানে স্থানান্তর করা হত তিনি তাকে বিদায় দিতেন। তাঁকে খাবারের কোন কিছু দেয়া হলে তা অন্যদের মাঝে বিতরণ করতেন। জেল সুপার, জেল ডাক্তার সবাই তাকে ভালবাসতো। তিনি কারাবন্দীদের খোঁজ-খবর রাখতেন। এমনকি কারাগারে যেসব প্রাণী থাকতো, তিনি তাদেরও যত্ন নিতেন, খাবার দিতেন। তিনি তাঁর আচরণে সবার মন জয় করেন। একবার তিনি অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন ছিলেন। কারাসঙ্গী অন্যরা তাঁর খিদমত করতেন। তিনি হাসপাতাল আঙ্গিনায় অন্যদের সাথে খোশ-গল্প করতেন। তিনি ছিলেন খুবই ধৈর্যশীল। ইখওয়ান নেতৃবৃন্দ পরামর্শের জন্য কারাগারে গেলে স্বাভাবিকভাবেই পরামর্শ দিতেন। কখনও কখনও ছোট বোন হামিদা কুতুবের মাধ্যমে পরামর্শ পাঠাতেন। সাইয়েদের কারাজীবনে মানসিকতার কোন পরিবর্তন ঘটেনি। একবার আদালতের কাঠগড়ায় তিনি দাঁড়ানো। তাঁর ভাই-বোনেরা তাঁকে দেখতে এসেছেন। সবাইকে দেখে তিনি মুচকি হাসলেন। আল্লাহ্র কাছে দোয়া করলেন এবং ধৈর্যের উপদেশ দিলেন।