Saturday 20 February 2010

সফল ছাত্রলীগনেতার সফলতার গল্প

শিবির বিরোধী এই অভিযানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক তানভীর শুধু দিক নির্দেশনাই দিচ্ছে, নিজে একশানে যাচ্ছে না। সে ভাল করেই জানে শিবির এখন চুপচাপ থাকবে কিন্তু সময় সুযোগ পেলে এর চরম প্রতিশোধ নিবে। যারা এখন অভিযানে সরাসরি অংশগ্রহন করছে তাদের নাম ইতিমধ্যে খরচের খাতায় লেখা হয়ে গেছে। এক এক করে সবাই একদিন অপঘাতে মারা যাবে, শিবির এমনই কঠিন এক চীজ। ইতিমধ্যে সকালে শিবিরের এক ক্যাডার তাকে মারার জন্য এসেছিল। হলে এসে তানভীরকে বহিরাগত এক দাঁড়িওয়ালা ছেলে খুঁজতে এসেছিল। হলের আরেক ছাত্র লীগ নেতা তাকে ধরে ফেলে। দুয়েক ঘা দেয়ার পরে ছেলেটি অজ্ঞান হয়ে পড়ে। জ্ঞান ফিরলে ওই ছেলেকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা যায় তানভীরের খোঁজ করছিল ছেলেটি। পরে আবার মার শুরু হয়। ভাগ্য ভাল ওই সময় তানভীর হলে ছিল না। ভোরে কেন্দ্রীয় অফিসে গিয়েছিল। হলে ফেরার পরে এই ঘটনা শুনছে। কেন্দ্রীয় অফিসে প্রবেশের সময় মোবাইল বন্ধ করে রেখেছিল, পরে আর অন করতে খেয়াল হয়নি। মোবাইলে তাকে এই ঘটনা জানানোর চেষ্টা করেছিল হলের নেতারা, কিন্তু মোবাইলে তখন পাওয়া যায়নি। ওই ছেলেকে তানভীরের দেখতে ইচ্ছে করছে। রুমে একটা কাজ সেরে নিচে নেমে দেখে আসবে সেই শিবিরের ক্যাডারকে। শিবিরের কত্ত বড় সাহস! যেখানে সারা দেশে শিবির বিরোধী অভিযান চলছে সেখানে ঢাকা বিশববিদ্যালয়ের মত জায়গায় শিবির তার ক্যাডার পাঠায়! বড় বাড়াবাড়ি করছে এই সন্ত্রাসী সংগঠন। বাংলার মাটিতে তাদের ঠাঁই নাই।
ভাবতে ভাবতেই হলের এক নেতা তানভীরের কাছে এল। ছেলেটার মুখ শুকনা, মনে হয় কোন বিপদ ঘটেছে। নাম নোমান। সেকেন্ড ইয়ারে পড়লেও নোমান হল কমিটির ভাল পদে আছে। যেকোন সময় হল গরম করার তরিকা তার জানা আছে। মারামারি কাটাকাটিতে তার জুড়ি নেই।

নোমানঃ তানভীর ভাই একটা সমস্যা হয়ে গেছে।
তানভীরঃ কী সমস্যা?
নোমানঃ ছেলেটা মারা গেছে।
তানভীরঃ কোন ছেলেটা?
নোমানঃ সকালে শিবিরের যে ক্যাডার আপনাকে মারতে এসেছিল সেই ছেলে।
তানভীরঃ প্যাঁচাল তো লাগিয়ে দিলি, এখন হাই কমান্ডে ফোন করতে হবে। তোদের আসলে মাথা গরম। মাথা ঠান্ডা করে নেতৃত্ব দেয়া শিখ। এখনো সময় আছে। আমি যদি সকালে হলে থাকতাম তাহলে আর এই ঘটনা ঘটত না। দুই একটা চড় থাপ্পড় মেরে বিদায় করে দিতাম। এখন দেখি তোর জন্য কী করা যায়।

দশ মিনিট পর তানভীরের হাসি মুখ দেখা গেল।
তানভীরঃ এক কাজ কর, একটু পরে পুলিশ আসছে, ওদেরকে লাশটা দিয়ে দিস। লাশের ব্যবস্থা ওরাই করবে। আর পুলিশকে এই টাকাটা দিবি।
বলে ড্রয়ার থেকে দশ হাজার টাকা বের করে নোমানের হাতে তুলে দিল।

নোমান চলে গেল। তানভীরের মুখে বিজয়ের হাসি। এই নোমান ছেলেটাকে সে দশ হাজার টাকার বিনিময়ে কিনে ফেলেছে। সামনে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় কমিটি গঠনের সময় নোমানের মত অস্ত্র হাতে রাখা দরকার। এই যে, শিবিরের ক্যাডারকে এমন মার দিয়েছে যে মরেই গেছে। ওই ব্যটা আবার মুজাহিদ সেজেছে! নোমানের কাছে মার খেয়েই মরে যায় শালা রাজাকারের বাচ্চা।

নোমান জোর করে হাসি দিল। বলল, “ছেলেটা মনে হয় আফগান ফেরত জিহাদী। মরার আগেও আপনার নাম উচ্চারন করেছে। রাজাকারেরা দেশটাকে শেষ করে দিল। পোলাপাইনের মাথা খেয়ে দিয়েছে। ওদের টার্গেট থাকে মরার আগ পর্যন্ত ওদের দ্বায়িত্ব পালন করা। ওটাকে ওরা ঈমানী দ্বায়িত্ব মনে করে।”

তানভীরঃ ওর কাছে কোন অস্ত্র পাওয়া গিয়েছে?
নোমানঃ না। সে মনে হয় আপনার অবস্থান বের করতে এসেছিল। ওর কাজ হল আপনার অবস্থান তাদের বাহিনীকে জানিয়ে দেয়া। সেই বাহিনী তখন একশনে যাবে। হলে ঢুকার সময়ই তাকে আমি ফলো করি। ওর মোবাইল সীজ করি। মোবাইলের কল লিস্টের প্রথমেই আপনার নাম ছিল। সকাল আটটা থেকে দশটা পর্যন্ত আপনার মোবাইলে কমপক্ষে দশবার কল করেছিল। ধরে শুরু করি সেইরকম মাইর। যেহেতু আজ আপনাকে ওরা খুঁজতে এসেছে তাই আজ আর বাইরে বের হবেন না প্লীজ।

তানভীরের ঘাড়ের চুল কিছুক্ষনের জন্য খাড়া হয়ে গেল। কী মারাত্মক কথা। পকেটের পিস্তলটা ঠিকমত আছে কিনা দেখে নিল। যহোক কেন্দীয় অফিসে আজকের মিটিংটা খুব সফল হয়েছে। কেন্দ্রের এক গুরুত্বপূর্ণ পদ পেতে তেমন বড় কোন বাধা নেই। আজ বাইরে না বেরোলেও চলবে।

কিছুক্ষন পরে পুলিশের গাড়ী এল। পুলিশের গাড়ীতে লাশ তোলা হচ্ছে। দূর থেকে তানভীর সবই দেখল। লাশের মুখটা একেবারে থেতলে গেছে। মুখটা দেখে চেনা যায় না এটা মানুষ না কী? ছেলেটার গায়ে পাঞ্জাবী আর প্যান্ট। নিশ্চিত শিবির!

নোমান তানভীরের কাছে আসল, “তানভীর ভাই এই মোবাইলটা আপনার। মানে আপনাকে যে মারতে এসেছিল তার মোবাইল। গনিমতের মাল হিসেবে রাখেন। দারুন সেট N-95। বন্ধ করে রেখেছি। পুলিশকে দেই নাই।”
নোমান তানভীরের উদ্দেশ্যে চোখ টিপল। “আর ভাই আরেকটা কথা পুলিশকে আট হাজারে ম্যানেজ করেছি বাকী দুই হাজার টাকায় পোলাপাইনের জন্য নাস্তা আনতে পাঠিয়েছি”। বলেই নোমান শ্লোগানের সুরে চিৎকার করল, “ধর ধর শিবির ধর, সকাল বিকাল নাস্তা কর”। সাথের ‘পোলাপাইনেরাও’ শ্লোগানে সাড়া দিল। বাংলার প্রতিটি ঘরে যদি এমন ছেলে থাকত! তাহলে দেশটা শিবির মুক্ত হত কত আগে!!

গত মাসে তানভীর এই সেট দুইটা কিনেছিল। একটা গিফট করেছে ছোট ভাই সজীবকে আর আরেকটা হলের আরেক নেতাকে। সজীব তানভীরের চেয়ে দুই বছরের ছোট। সে কোন রাজনীতির সাথে নয়। তাবলীগ করে। বড় ভাল ছেলে। কয়েকদিন আগে বাবার সাথে টঙ্গীর তুরাগের তীরে এসেছিল। আগামীকাল ফিরে যাবে। আজ তার হলে আসার কথা। পিঠাপিঠি দুই ভাই, যেন মানিক-রতন। সজীব বাবা মায়ের সাথে বাড়ীতে থাকে। দুইজন দুইজনকে নাম ধরে ডাকে। ভাবতে ভাবতে শিবির ক্যাডারের মোবাইলটার সুইচ অন করল।

ভাইয়ের কথা ভাবছে এমন সময় বাবার কল এল। বাবা এইবার বিশ্ব ইজতেমায় এসেছে। সজীব আর বাবা একসাথেই থেকেছে।
বাবাঃ তানভীর দেখত বাবা, সজীব সেই সকালে তোর খোঁজে তোর ওখানে গিয়েছে এখন পর্যন্ত তার কোন খবর পেলাম না। তোর সাথে দেখা হয়েছে? বেচারার এমনিতে জ্বর ছিল। তোর সাথে দেখা না করে বাড়ী যাবে না তাই তোর হলে গিয়েছিল। ওর মোবাইল সকাল থেকে বন্ধ পাচ্ছি।
তানভীরঃ দেখছি আব্বা। আপনি কোন চিন্তা করবেন না।
আরো কিছু কথা বলে তানভীর সজীবের মোবাইলে কল করল। বাম হাতের সেই N-95 ভাইব্রেশনে কেঁপে উঠল। মনে হচ্ছে তানভীরের সারা শরীর কেঁপে উঠেছে। রিং টোন হচ্ছে সূরা ইয়াসীন! এটা সজীবের প্রিয় রিং টোন। কাঁপা হাতে বাম হাতের N-95 সেটটা চোখের সামনে আনার পরে চারিদিক অন্ধকার হয়ে গেল। ইনকামিং কলের নাম দেখাচ্ছে ‘TANVIR’। লাশটা তখন মাত্র গাড়ীতে তোলা হয়েছে। গাড়ী ছেড়ে দিবে। তানভীর দৌড়ে পুলিশের গাড়ীর কাছে এল। লাশের মুখে কাপড় সরিয়ে দিল। যদিও লাশটা বিকৃত তবুও তানভীরের কোন সন্দেহ রইল না এ লাশ সজীবের।

তানভীরের পেছনে হলে আনন্দ মিছিল হচ্ছে- ধর ধর শিবির ধর, সকাল বিকাল নাস্তা কর।

মুল লেখাটি এখানে
উৎসর্গঃ ছোটবেলার গৃহশিক্ষক চট্টগ্রাম বিশববিদ্যালয়ের বামপন্থী মেধাবী ছাত্র নেতা সঞ্জয় তলাপাত্রকে যিনি দাঁড়ি রাখার সুবাদে ‘শিবির’ সন্দেহে চট্টগ্রাম রেইলস্টেশনে ছাত্রলীগের বেদম মার খান, পরে হাসপাতালে মারা যান। ভালবাসা দিবসে ওনার প্রতি ভালবাসা রইল।

No comments:

Post a Comment